পর্তুগাল ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি মনোমুগ্ধকর দেশ। এটি তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সুন্দর স্থাপত্য এবং আধুনিক অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই পর্তুগালে যেতে আগ্রহী কারণ এটি শুধুমাত্র একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য নয় বরং কাজ ও শিক্ষার জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। তবে পর্তুগালে যেতে হলে প্রথমেই ভিসার প্রয়োজন এবং এর খরচ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। তাই আজকের এই পোস্টে আমরা বিভিন্ন ধরনের পর্তুগাল ভিসার দাম কত এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
পর্তুগাল ভিসার প্রকারভেদ
পর্তুগালে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন প্রকারের ভিসা পাওয়া যায়। প্রতিটি ভিসার ধরন অনুযায়ী আবেদন প্রক্রিয়া এবং ফি ভিন্ন হতে পারে। প্রধান ভিসাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
পর্যটন ভিসা: পর্যটন ভিসা তাদের জন্য যারা পর্তুগালে পর্যটন, অবকাশ যাপন বা পরিবার/বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চান। এটি সাধারণত স্বল্পমেয়াদী ভিসা হিসেবে দেওয়া হয় এবং সাধারণত ৯০ দিনের জন্য বৈধ থাকে। এই ভিসা দিয়ে আপনি শুধুমাত্র ভ্রমণ করতে পারবেন। কাজ বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে এই ভিসা ব্যবহার করা যায় না।
শিক্ষার্থী বা স্টুডেন্ট ভিসা: শিক্ষার্থী ভিসা তাদের জন্য যারা পর্তুগালে শিক্ষার জন্য যাচ্ছেন। এই ভিসা দিয়ে তারা শিক্ষালাভের পুরো সময়কাল সেখানে থাকতে পারবেন। এটি সাধারণত একাডেমিক কোর্সের মেয়াদকাল অনুযায়ী বৈধ থাকে এবং প্রয়োজন হলে নবায়ন করা যায়।
ওয়ার্ক পারমিট ভিসা: যারা কাজের জন্য পর্তুগালে যাচ্ছেন তাদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ভিসা প্রয়োজন। এটি সাধারণত চাকরিদাতার পক্ষ থেকে দেওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য বৈধ থাকে। কাজের ধরনের উপর ভিত্তি করে ভিসার মেয়াদকাল এবং শর্তাবলী ভিন্ন হতে পারে।
ব্যবসায়িক ভিসা: ব্যবসায়িক ভিসা তাদের জন্য যারা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যেমন মিটিং, কনফারেন্স বা অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যকলাপের জন্য পর্তুগালে যাচ্ছেন। এই ভিসা সাধারণত স্বল্পমেয়াদী হয় এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পন্ন করার সময়কাল অনুযায়ী বৈধ থাকে।
পারিবারিক ভিসা: যাদের পরিবার বা নিকট আত্মীয় পর্তুগালে বাস করেন তারা এই ভিসা নিয়ে তাদের সাথে থাকার জন্য যেতে পারেন। এই ভিসার মাধ্যমে আবেদনকারী তার পরিবারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের সুযোগ পান।
অন্যান্য বিশেষ ভিসা: কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন গবেষণা, চিকিৎসা বা সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রোগ্রামের জন্য বিশেষ ভিসা দেওয়া হয়। এই ভিসাগুলোর জন্য নির্দিষ্ট শর্তাবলী এবং প্রয়োজনীয়তা থাকে।
পর্তুগাল ভিসার দামের তালিকা
ভিসার ধরন | দাম (বাংলাদেশি টাকায়) |
পর্যটন ভিসা | ৭,৬০০ – ১০,২০০ টাকা। |
শিক্ষার্থী ভিসা | ১১,৪০০ – ১২,৭০০ টাকা। |
ওয়ার্ক পারমিট ভিসা | ১৫,৩০০ – ১৯,১০০ টাকা। |
সাধারন ওয়ার্ক পারমিট | ১৫,৩০০ টাকা। |
Highly Skilled Worker | ১৯,১০০ টাকা। |
ICT (Intra-Corporate Transfer) | ১৬,৫০০ টাকা। |
EU Blue Card | ২০,৩০০ টাকা। |
Seasonal Worker | ১৫,০০০ টাকা। |
ব্যবসায়িক ভিসা | ৭,৬০০ – ১০,৫০০ টাকা। |
পারিবারিক ভিসা | ৭,৬০০ – ১০,২০০ টাকা। |
পর্তুগাল ভিসার দাম কত ২০২৪
২০২৪ সালে পর্তুগাল ভিসার ফি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ভিসার জন্য ফি ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত:
- পর্যটন ভিসা: পর্যটন ভিসার জন্য ফি সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ ইউরো হয়ে থাকে যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭,৬০০ থেকে ১০,২০০ টাকা।
- স্টুডেন্ট বা শিক্ষার্থী ভিসা: শিক্ষার্থী ভিসার জন্য ফি ৯০ থেকে ১০০ ইউরো যা প্রায় ১১,৪০০ থেকে ১২,৭০০ টাকা।
- ওয়ার্ক পারমিট ভিসা: ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য ফি ১২০ থেকে ১৫০ ইউরো যা প্রায় ১৫,২৫০ থেকে ১৯,০০০ টাকা।
- ব্যবসায়িক ভিসা: ব্যবসায়িক ভিসার জন্য ফি ৬০ থেকে ৮০ ইউরো যা প্রায় ৭,৬০০ থেকে ১০,২০০ টাকা।
- পারিবারিক ভিসা: পারিবারিক ভিসার জন্য ফি ৬০ থেকে ৮০ ইউরো যা প্রায় ৭,৬০০ থেকে ১০,২০০ টাকা।
এই ফি ছাড়াও অতিরিক্ত খরচ যেমন প্রক্রিয়াকরণ ফি, সার্ভিস চার্জ ইত্যাদি থাকতে পারে। ভিসার ধরন এবং সময়কাল অনুযায়ী ফি পরিবর্তিত হতে পারে তাই নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য পর্তুগালের দূতাবাস বা কন্সুলেটে যোগাযোগ করা উচিত।
পর্তুগাল ওয়ার্ক পারমিট ভিসা কত টাকা
ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য নির্ধারিত ফি সাধারণত ১২০ থেকে ১৫০ ইউরো হয়ে থাকে যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫,২০০ থেকে ১৯,১০০ টাকা। তবে কাজের ধরন এবং কোম্পানির উপর ভিত্তি করে এই ফি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। এছাড়াও ভিসা প্রসেসিং ফি, সার্ভিস চার্জ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হবে। কাজের ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন এবং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত খরচও যোগ হতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে পর্তুগাল যাওয়ার নিয়ম
বাংলাদেশ থেকে পর্তুগাল যাওয়ার জন্য ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে আবেদনকারীকে অনলাইনে আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জোগাড় করতে হবে। এই ডকুমেন্টসের মধ্যে থাকতে পারে:
- বৈধ পাসপোর্ট: আবেদনকারীর পাসপোর্টের মেয়াদ অবশ্যই ভিসার আবেদনকৃত সময়কাল শেষে কমপক্ষে ছয় মাস থাকতে হবে।
- ভিসা আবেদন ফর্ম: অনলাইনে পূরণ করা ফর্মটি প্রিন্ট করে জমা দিতে হবে।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি: নির্দিষ্ট মান অনুসারে তোলা ছবি জমা দিতে হবে।
- ফ্লাইট বুকিং এবং থাকা-খাওয়ার প্রমাণ: পর্তুগালে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রমাণ করতে হবে।
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা ফাইনান্সিয়াল সাপোর্টের প্রমাণ: আপনার অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে।
- স্বাস্থ্য বীমা: ভ্রমণের সময়কালের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য বীমা থাকতে হবে।
- অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস: যেমন শিক্ষার্থী ভিসার ক্ষেত্রে অ্যাডমিশন লেটার।
আবেদন ফর্ম জমা দেওয়ার পর আবেদনকারীকে ভিসা ইন্টারভিউতে অংশ নিতে হতে পারে। ভিসা ইন্টারভিউতে সাধারণত আবেদনকারীর ভ্রমণের উদ্দেশ্য, আর্থিক সামর্থ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়।
বাংলাদেশ থেকে পর্তুগাল যেতে কত টাকা লাগে
বাংলাদেশ থেকে পর্তুগাল যেতে বেশ কয়েকটি খরচ যুক্ত হয়। ভিসা ফি ছাড়াও অন্যান্য খরচগুলো হলো:
- ভিসা ফি: প্রায় ৭,৬০০ থেকে ১৯,১০০ টাকা ভিসার ধরন অনুযায়ী।
- বিমান ভাড়া: সাধারণত ৬০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে সিজন এবং এয়ারলাইন অনুযায়ী।
- প্রাথমিক থাকা-খাওয়ার খরচ: প্রথম কয়েক সপ্তাহের জন্য হোটেল বা রেন্টাল অ্যাপার্টমেন্টের খরচ যা ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা হতে পারে।
- অন্য আনুষঙ্গিক খরচ: যেমন যাতায়াত খরচ, খাবার এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত খরচ।
পর্তুগালে যাওয়ার প্রস্তুতি
ভিসা পাওয়ার পর, পর্তুগালে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। প্রথমে ফ্লাইট বুকিং করতে হবে এবং যাওয়ার তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। এরপর থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা প্রথমবার যাচ্ছেন তাদের জন্য হোটেল বা রেন্টাল অ্যাপার্টমেন্ট বুক করা উত্তম। এছাড়া প্রয়োজনীয় সমস্ত ডকুমেন্টস সঙ্গে রাখা উচিত এবং যাত্রার আগে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা উচিত।
ফ্লাইট বুকিং করার সময় সেরা ডিল পাওয়ার জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইনের ওয়েবসাইট এবং ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া এয়ারলাইনগুলোর অফার এবং ডিসকাউন্ট সম্পর্কে অবহিত থাকা উচিত। ফ্লাইট বুকিংয়ের সময় ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স কেনা গুরুত্বপূর্ণ যা যাত্রা চলাকালীন যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে পারে।
থাকার জায়গার জন্য হোটেল, রেন্টাল অ্যাপার্টমেন্ট বা হোস্টেল বেছে নেওয়া যেতে পারে। পর্তুগালে থাকার জন্য প্রাথমিক খরচ কমাতে হলে হোস্টেল বা শেয়ার্ড অ্যাপার্টমেন্ট একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়।
পর্তুগালের জীবনযাত্রা – পর্তুগাল ভিসার দাম কত
পর্তুগালের জীবনযাত্রা বাংলাদেশের তুলনায় বেশ ভিন্ন। বাসস্থান, খাদ্য, পরিবহন এবং অন্যান্য দৈনন্দিন খরচের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পর্তুগালে থাকার খরচ সাধারণত বড় শহরগুলোতে বেশি হয়। বাসস্থান খরচ প্রতি মাসে প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। খাদ্য এবং অন্যান্য খরচের জন্য আরও ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা মাসিক খরচ হতে পারে।
পর্তুগালে থাকতে হলে স্থানীয় ভাষা পর্তুগিজ শেখা অনেক উপকারী হতে পারে। যদিও বড় শহরগুলোতে ইংরেজি বেশ ভালোভাবে প্রচলিত তবে দৈনন্দিন জীবনে স্থানীয় ভাষার জ্ঞান অনেক কাজে আসে। পর্তুগালে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র এবং অনলাইন কোর্স পাওয়া যায় যা নতুন ভাষা শেখার জন্য সহায়ক।
পর্তুগালে কাজ এবং ক্যারিয়ার
পর্তুগালে কাজের সুযোগ বেশ ভালো। বিভিন্ন সেক্টরে কাজের চাহিদা আছে যেমন আইটি, ট্যুরিজম, রেস্টুরেন্ট এবং নির্মাণ শিল্প। কাজের পরিবেশ সাধারণত ভালো এবং বেতন কাঠামোও সন্তোষজনক। বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রবাসীরা পর্তুগালে কাজ করতে যান তাদের জন্য পর্তুগালের কর্মসংস্থান বাজার আকর্ষণীয় হতে পারে। তবে স্থানীয় ভাষা শিখে নেওয়া উপকারী হতে পারে। কারণ বেশিরভাগ চাকরির ক্ষেত্রে পর্তুগিজ ভাষার জ্ঞান প্রয়োজন।
পর্তুগালে কাজের বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন সম্পূর্ণ করতে হবে। কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো চাকরি পাওয়া সহজ হয়। এছাড়া বিভিন্ন জব পোর্টাল এবং রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে চাকরির সন্ধান করা যেতে পারে।
উপসংহার – পর্তুগাল ভিসার দাম কত
পর্তুগালে যাওয়ার জন্য সঠিক ভিসার প্রকার এবং এর ফি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন এবং অন্যান্য খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এবং সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে গেলে পর্তুগালে যাত্রা সহজতর হবে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য পর্তুগাল একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে যেখানে তারা নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা খুঁজে পেতে পারেন। পর্তুগালের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, সুন্দর পরিবেশ এবং উন্নত জীবনের মান অনেকের জন্য একটি আকর্ষণীয় প্রস্থান হতে পারে।
পর্তুগালে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ হতে পারে। তবে সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে গেলে সফলভাবে ভিসা পাওয়া সম্ভব। পর্তুগালে থাকার সময় সেখানকার স্থানীয় নিয়ম-কানুন এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। এতে করে প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা আরো মধুর এবং স্মরণীয় হয়ে উঠবে।