পলাশ গাছ (Butea monosperma) যা বসন্তের আগমনী বা ‘ফ্লেম অফ দ্য ফরেস্ট’ নামেও পরিচিত। আমাদের উপমহাদেশের একটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় গাছ। এই গাছটি বিশেষত ভারত এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। পলাশ গাছের ফুল বসন্তকালে ফোটে এবং সেই সময় গাছটি দারুণ সুন্দর দেখায়। এর উজ্জ্বল লাল বা কমলা রঙের ফুলগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে বসন্তের আগমন বার্তা দেয়। পলাশ গাছের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে যা বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। বাংলার কবিতা এবং গানে পলাশ ফুলের রঙিন ছোঁয়া পাওয়া যায় যা এই গাছের প্রতি মানুষের ভালোবাসার পরিচয় দেয়।
পলাশ গাছের বৈশিষ্ট্য
পলাশ গাছের বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যন্ত অনন্য এবং চিত্তাকর্ষক। এই গাছটি সাধারণত ১২ থেকে ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বড় হয়। পলাশ গাছের পাতা বড় এবং ত্রিপর্ণযুক্ত যা তিনটি বড় পত্রক থেকে গঠিত। পাতাগুলো সাধারণত ১০-২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হয় এবং প্রান্তগুলো কিছুটা করাতদাঁতের মতো। পলাশ গাছের কাণ্ড ও ডালপালা সাধারণত ঘন এবং শক্ত হয় যা গাছটিকে স্থায়ী এবং মজবুত করে তোলে।
পলাশ গাছের ফুলগুলো উজ্জ্বল লাল বা কমলা রঙের হয় যা বসন্তকালে গাছকে এক নতুন রূপ দেয়। ফুলগুলো সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ফোটে। ফুলের আকৃতি সাধারণত কাঁটার মতো হয় এবং এটি গাছের শাখায় ঘন ঘন ফোটে। পলাশ গাছের বৃদ্ধি প্রধানত উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুতে ভাল হয় যদিও এটি বিভিন্ন ধরণের মাটিতে জন্মাতে সক্ষম। এই গাছটি সাধারণত বেলে মাটি এবং ভাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা মাটিতে ভাল জন্মায়।
পলাশ গাছের দাম কত ২০২৪
২০২৪ সালে পলাশ গাছের দাম বিভিন্ন দেশে ভিন্ন হতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশে সাধারণত পলাশ গাছের চারা ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। চারা কেনার ক্ষেত্রে গাছের আকার, বয়স এবং চারার অবস্থার উপর ভিত্তি করে দাম পরিবর্তিত হতে পারে। বড় এবং পূর্ণবয়স্ক গাছের দাম আরও বেশি হতে পারে যা প্রায় ১০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন নার্সারি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দাম কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
অন্যদিকে অন্যান্য দেশে পলাশ গাছের চাহিদা এবং সরবরাহের উপর ভিত্তি করে দাম ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে এই গাছের চারা আমদানি করে আনতে হলে দাম আরও বেশি হতে পারে। সেখানে পলাশ গাছের চারা পাওয়া যায় কম তাই আমদানি ব্যয় এবং অন্যান্য খরচ যোগ হওয়ার কারণে দাম বেশি হয়।
পলাশ গাছের চারা কোথায় পাওয়া যায়
পলাশ গাছের চারা সাধারণত স্থানীয় নার্সারিতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন নার্সারিতে সাশ্রয়ী দামে পলাশ গাছের চারা বিক্রি হয়। নার্সারিতে সাধারণত বিভিন্ন আকারের এবং বয়সের পলাশ গাছের চারা পাওয়া যায় যা বিভিন্ন ক্রেতার প্রয়োজন অনুসারে থাকে। এছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও পলাশ গাছের চারা পাওয়া যায়। অনেক ওয়েবসাইট এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পলাশ গাছের চারা বিক্রি করে যা ক্রেতারা ঘরে বসেই অর্ডার করতে পারেন।
কৃষি মেলা এবং স্থানীয় বাজারেও পলাশ গাছের চারা পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত বসন্তকালে যখন পলাশ গাছের ফুল ফোটে তখন অনেক কৃষি মেলা এবং বাজারে পলাশ গাছের চারা বিক্রি হয়। এই মেলাগুলোতে চারা ক্রয় করা সুবিধাজনক কারণ ক্রেতারা সরাসরি বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে চারা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেন।
পলাশ গাছের উপকারিতা
পলাশ গাছের উপকারিতা অনেক এবং এটি বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশগত দিক থেকে পলাশ গাছ মাটি সংরক্ষণে সহায়ক এবং এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। পলাশ গাছের ছাল এবং ফুল ঔষধি গুণাবলীর জন্য পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় পলাশ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়।
পরিবেশগত উপকারিতা
পলাশ গাছ মাটির সংরক্ষণ এবং ক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মূল ব্যবস্থা মাটিকে মজবুত করে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। পলাশ গাছের পাতা এবং ফুলগুলো পচে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে যা কৃষির জন্য উপকারী। এছাড়া পলাশ গাছ বিভিন্ন প্রকার পাখি এবং কীটপতঙ্গের জন্য বাসস্থান সরবরাহ করে যা জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক।
ঔষধি গুণাবলী
পলাশ গাছের বিভিন্ন অংশ ঔষধি গুণাবলীর জন্য পরিচিত। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় পলাশ গাছের ছাল, পাতা এবং ফুল বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। পলাশ গাছের ছাল থেকে তৈরি ওষুধ সাধারণত জ্বর, ডায়রিয়া এবং সর্দি কাশির চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। পলাশ ফুল থেকে তৈরি রস ত্বকের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
অর্থনৈতিক মূল্য
পলাশ গাছের কাঠ অর্থনৈতিক দিক থেকেও মূল্যবান। কাঠটি হালকা এবং মজবুত হওয়ায় এটি আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া পলাশ গাছের ফুলগুলো প্রাকৃতিক রং তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় যা কাপড় এবং অন্যান্য জিনিস রঙ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক রং হওয়ায় এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত।
পলাশ গাছের চাষাবাদ
পলাশ গাছের চাষাবাদ বেশ সহজ এবং এটি মাটির ধরণ এবং জলবায়ুর উপর নির্ভর করে। পলাশ গাছ সাধারণত বেলে মাটি এবং ভাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা মাটিতে ভাল জন্মায়। গাছটির বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ জলবায়ু প্রয়োজন হয় এবং এটি কম বৃষ্টিপাত সহ্য করতে সক্ষম। পলাশ গাছের চারা রোপণের পর প্রথম কয়েক বছর নিয়মিত পানি দেওয়া প্রয়োজন। গাছটি পরিণত হওয়ার পর পানি দেওয়ার প্রয়োজন কমে যায়।
চাষের জন্য মাটি এবং জলবায়ুর প্রয়োজনীয়তা
পলাশ গাছের চাষের জন্য ভাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা বেলে মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ মান সাধারণত ৬ থেকে ৭ এর মধ্যে থাকা উচিত। পলাশ গাছ উষ্ণ এবং শুষ্ক জলবায়ুতে ভাল জন্মায় তবে এটি বিভিন্ন ধরনের আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে সক্ষম। গাছটি প্রখর রোদ সহ্য করতে পারে এবং কম বৃষ্টিপাতেও বেঁচে থাকতে পারে।
গাছের যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ
পলাশ গাছের যত্ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে প্রথম দিকে নিয়মিত পানি দেওয়া প্রয়োজন। চারা রোপণের পর প্রথম দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত নিয়মিত পানি দেওয়া উচিত। এছাড়া গাছের চারপাশের আগাছা পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন যাতে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত না হয়। পলাশ গাছ সাধারণত রোগ এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় তবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
কীটপতঙ্গ এবং রোগ প্রতিরোধ
পলাশ গাছ বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ এবং রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। সাধারণত পলাশ গাছ রোগ প্রতিরোধী তবে কিছু ক্ষেত্রে পাতা বা ফুলের উপর কীটপতঙ্গ আক্রমণ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া গাছের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ছাঁটাই করা প্রয়োজন।
পলাশ গাছের ফুলের ব্যবহার
পলাশ গাছের ফুলের বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে। ফুলগুলো শোভাকর উদ্যান এবং ল্যান্ডস্কেপিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। উজ্জ্বল রঙের কারণে এই ফুলগুলো বসন্তকালে উদ্যানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। পলাশ গাছের ফুলগুলো প্রাকৃতিক রং তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় যা কাপড় এবং অন্যান্য জিনিস রঙ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক রং হওয়ায় এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত।
গাছ সংরক্ষণ এবং রক্ষা
পলাশ গাছ সংরক্ষণ এবং রক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বনায়ন এবং পুনঃবনায়ন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পলাশ গাছের চারা রোপণ করা হয়। স্থানীয় এবং জাতীয় স্তরে সংরক্ষণ প্রচেষ্টাও চলছে। পলাশ গাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও এবং পরিবেশ সংস্থা পলাশ গাছ সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।
বনায়ন এবং পুনঃবনায়ন প্রকল্প
বনায়ন এবং পুনঃবনায়ন প্রকল্পগুলো পলাশ গাছ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পলাশ গাছের চারা রোপণ করা হয় এবং গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। স্থানীয় সরকার এবং এনজিওগুলোর সহযোগিতায় এই প্রকল্পগুলো পরিচালিত হয়।
স্থানীয় এবং জাতীয় স্তরে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
পলাশ গাছ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় এবং জাতীয় স্তরে বিভিন্ন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা পলাশ গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। স্কুল এবং কলেজগুলিতে পরিবেশ শিক্ষার অংশ হিসেবে পলাশ গাছ সংরক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার
পলাশ গাছ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের একটি অমূল্য অংশ। এর বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা এবং সৌন্দর্য একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ২০২৪ সালে পলাশ গাছের দাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি গাছটির চাহিদা এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে। পলাশ গাছের গুরুত্ব এবং মূল্যায়ন আরও বাড়াতে আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত এবং গাছটির সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে পলাশ গাছের চাহিদা এবং দাম পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে তাই এই গাছের প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া জরুরি।
পলাশ গাছ শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশও বটে। এর ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এর অবস্থানকে আরও মজবুত করে। তাই পলাশ গাছের সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব।