বাংলাদেশে নিম গাছের জনপ্রিয়তা প্রাচীনকাল থেকেই আছে। এই গাছের পরিচিতি মূলত এর ঔষধি গুণাবলীর কারণে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিম গাছের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশে এটির মূল্য অপেক্ষাকৃত কম এবং সহজলভ্য। ২০২৪ সালে নিম গাছের চারা কেনার আগ্রহ বাংলাদেশে আগের চেয়ে বেড়েছে। কাঁচা পাতা থেকে শুরু করে নিমের কাঠ সব কিছুই স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই আর্টিকেলে আমরা নিম গাছের চারার দাম, কেনার সঠিক পদ্ধতি এবং কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আরো পড়ুনঃ দেবদারু গাছের চারার দাম
নিম গাছের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নিম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Azadirachta indica এবং এটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় একটি গাছ। এটি বিভিন্ন ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ একটি বৃক্ষ। নিম গাছ বাংলাদেশে সহজলভ্য হওয়ার কারণে এটি বিশেষভাবে পরিচিত। নিম গাছের মূল, পাতা, ছাল এবং বীজ—সব অংশই কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার হয়। অনেক গ্রামাঞ্চলে নিম গাছকে ঘরের আঙিনায় লাগানোর রীতি প্রচলিত কারণ এটি বাতাস পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং পোকামাকড় প্রতিরোধে কার্যকর।
কেন নিম গাছ লাগানো উচিত
নিম গাছ লাগানোর অনেক উপকারিতা রয়েছে। প্রথমত এটি প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে যা কৃষিজমিতে বিভিন্ন পোকামাকড় দূর করতে সাহায্য করে। নিম গাছের পাতার রস ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করে যা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী। পরিবেশগত দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ নিম গাছ বাতাস থেকে ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করতে সক্ষম। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাতাস দূষণ রোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নিম গাছের চারা কেনার উপায়
নিম গাছের চারা কেনার ক্ষেত্রে বর্তমানে বেশ কিছু বিকল্প রয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন নার্সারি এবং কৃষিপণ্যের দোকানে নিমের চারা পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিতেও নিম গাছের চারা কেনার সুযোগ রয়েছে। নিম গাছের চারা কেনার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত, যেমন চারার স্বাস্থ্য, বয়স এবং সঠিক জাত। নার্সারি থেকে কিনলে সাধারণত দাম তুলনামূলকভাবে কম হয় কারণ এতে পরিবহন খরচ বা অন্যান্য মধ্যস্থ খরচ কম থাকে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চারা কেনার সুবিধা হলো এখান থেকে সহজে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা পাওয়া যায়। তবে অনলাইন কেনাকাটায় চারার স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে তাই নির্ভরযোগ্য দোকান বা প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনা উচিত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে একটি চারার দাম ৮০-১৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে যা বিভিন্ন ধরনের চারার উপর নির্ভর করে।
২০২৪ সালে নিম গাছের চারার দাম কত
২০২৪ সালে নিম গাছের চারার দাম বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন হতে পারে। নার্সারির অবস্থান, চারার স্বাস্থ্য এবং জাতের উপর ভিত্তি করে দাম কমবেশি হয়।
বিভিন্ন স্থানের দাম ২০২৪
- ঢাকা: ৬০-১০০ টাকা (সাধারণ জাত) থেকে ১০০-১৫০ টাকা (উন্নত জাত)।
- চট্টগ্রাম: ৭০-১২০ টাকা উন্নত জাতের জন্য একটু বেশি।
- রাজশাহী: ৫০-৯০ টাকা (সাধারণ জাত) উন্নত জাতের ক্ষেত্রে ১২০ টাকা পর্যন্ত।
- খুলনা: ৬০-১১০ টাকা নির্ভরযোগ্য নার্সারিতে।
- সিলেট: ৬৫-১২০ টাকা (অঞ্চলভেদে সামান্য পার্থক্য হতে পারে)।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দাম কিছুটা বেশি হতে পারে কারণ এর সাথে পরিবহন ও প্যাকেজিং খরচ যুক্ত হয়। নিম গাছের চারার দাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চারার আকার এবং বয়সের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত ছোট চারা কম দামে পাওয়া যায় যা ৪০-৬০ টাকার মধ্যে হতে পারে। বড় ও উন্নত জাতের চারার জন্য ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত দাম হতে পারে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিম গাছের চারার দাম
বর্তমানে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সহজেই নিম গাছের চারা কিনতে পারেন, যেমন Daraz, Chaldal এবং Facebook Marketplace। এখানে বিভিন্ন ধরনের নিম গাছের চারা পাওয়া যায় এবং দামও বিভিন্ন রকমের।
অনলাইন দাম তালিকা (প্রায়):
- Daraz: ৮০-১৩০ টাকা (ছোট চারা), ১৫০-২০০ টাকা (বড় চারা বা উন্নত জাত)।
- Chaldal: ৯০-১৫০ টাকা।
- Facebook Marketplace: স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে দরাদরি করে ৬০-১০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্রথমত দোকানের রেটিং ও রিভিউ যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ যাতে আপনি একটি ভালো মানের চারা পেতে পারেন। অনলাইন কেনাকাটায় সরাসরি চারা দেখতে না পারার কারণে এটি একটি ঝুঁকির বিষয় হতে পারে। তবে ভালোভাবে যাচাই করলে আপনি সেরা চারাটি পাবেন।
নিম গাছের চারা কেনার সময় সতর্কতা
নিম গাছের চারা কেনার সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। এই সতর্কতাগুলো মেনে চললে আপনি একটি সুস্থ ও ভালো মানের চারা কিনতে পারবেন যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
চারার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন: প্রথমত চারা কেনার সময় চারার গায়ে পোকামাকড়ের দাগ, ফাংগাল সংক্রমণ বা অন্যান্য রোগের লক্ষণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিন। সুস্থ চারা সাধারণত সবুজ ও সতেজ হয়।
আরো পড়ুনঃ চন্দন গাছের বীজের দাম
চারার বয়স: নিম গাছের চারার বয়স কিনতে যাওয়ার আগে জানুন। খুব ছোট চারা তুলনামূলকভাবে কম খরচে পাওয়া গেলেও দ্রুত ফল পেতে চাইলে কিছুটা পরিণত চারা কিনতে পারেন।
নার্সারির পরিচ্ছন্নতা: নার্সারি বা দোকানের পরিচ্ছন্নতা ও গাছের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করুন। পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন নার্সারিতে চারা বেশি ভালো মানের হয়।
জাতের বৈচিত্র্য: ভালো নার্সারিগুলোতে উন্নত জাতের নিম চারা পাওয়া যায়। উন্নত জাতের চারার দাম কিছুটা বেশি হলেও এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
সতর্কতার সাথে চারা বাছাই করলে আপনার গাছ সুস্থভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রুত ফুল, ফল বা কাঠ পাওয়া সম্ভব হবে।
নিম গাছের চারা রোপণ পদ্ধতি
নিম গাছের চারা রোপণের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে রোপণ করলে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং সুস্থ থাকবে।
- মাটির ধরন: নিম গাছের জন্য সাধারণত উর্বর ও পানি নিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন মাটি উত্তম। মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে নিলে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।
- রোপণের সময়: গ্রীষ্মকালে বা বর্ষার শুরুতে নিম গাছের চারা লাগানো সর্বোত্তম কারণ এ সময় মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকে যা গাছের শেকড় দ্রুত বিকাশে সাহায্য করে।
- গর্তের গভীরতা: চারার জন্য প্রায় ১-১.৫ ফুট গভীর গর্ত খনন করুন যাতে চারাটি সঠিকভাবে বসানো যায়। মাটি ভালোভাবে ঝরঝরে করুন।
- পানি দেওয়া: চারা রোপণের পরপরই পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে। তবে পানি যেন খুব বেশি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি শুকিয়ে গেলে আবার পানি দিন।
নিয়মিত সঠিক যত্নের মাধ্যমে নিম গাছের চারা শক্তিশালী ও সুস্থ হয়ে উঠবে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
নিম গাছের পরিচর্যার টিপস
নিম গাছের চারা দ্রুত বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য কিছু পরিচর্যা করতে হয়। পরিচর্যার মাধ্যমে গাছটি আরও শক্তিশালী হয় এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়।
- সার প্রয়োগ: নিম গাছের চারা লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকে জৈব সার বা কম্পোস্ট সার দিন। এতে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। প্রতি ছয় মাস অন্তর সারে নতুন করে প্রয়োগ করুন।
- পোকামাকড় প্রতিরোধ: নিম গাছ নিজেই প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে পরিচিত হলেও চারার শুরুর সময়ে কিছু ছত্রাকনাশক স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ছায়া ও আলো: নিম গাছ পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পছন্দ করে। তবে চারার শুরুতে কিছুটা ছায়া দিলেও চলবে। যখন গাছ একটু বড় হয় তখন খোলামেলা জায়গায় রাখতে পারেন।
- পরিষ্কার রাখা: চারার আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখুন যাতে অন্যান্য উদ্ভিদের কারণে পুষ্টির ভাগাভাগি না হয়।
পরিচর্যার মাধ্যমে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং নিম গাছটি রোগমুক্ত থাকে।
নিম গাছ থেকে আর্থিক লাভ
নিম গাছ আর্থিক দিক থেকেও লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিম গাছের পাতা, বীজ এবং কাঠের বাজার রয়েছে। গাছটি যখন পরিণত হয় তখন এটি থেকে কাঠ এবং অন্যান্য উপকরণ বিক্রি করে আয় করা সম্ভব।
- নিম কাঠ: নিম গাছের কাঠ খুবই মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। এটি ফার্নিচার এবং অন্যান্য কাঠের পণ্যে ব্যবহার করা হয়। নিম কাঠের বাজারমূল্য বেশ ভালো থাকে।
- নিম পাতা ও বীজ: নিম গাছের পাতা ও বীজ থেকে তৈরি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। নিম তেল, নিম পাউডার ইত্যাদি বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়।
- চারা বিক্রয়: অনেকে নিজেই নিম গাছের চারা উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করেন। চারার দাম ৫০-১৫০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে যা চারা বয়স এবং মানের উপর নির্ভর করে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে নিম গাছের চাষ করা লাভজনক হতে পারে বিশেষ করে যারা বাড়তি আয় করতে চান তাদের জন্য এটি একটি ভাল বিকল্প।
চারা সংগ্রহের পরবর্তী ধাপ
নিম গাছের চারা কেনার পর এটি যত্নের প্রয়োজন। চারা সংগ্রহের পর সঠিক যত্ন করলে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ থাকে।
- পরিবহন ও সংরক্ষণ: চারা পরিবহনের সময় সাবধানে থাকতে হবে। চারার গোড়া এবং শেকড় যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- রোপণের সময় নির্ধারণ: সংগ্রহের পরপরই চারা রোপণ করা উচিত। তবে যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে ছায়ায় চারা রাখুন এবং নিয়মিত পানি দিন।
- পুনরায় পর্যালোচনা: চারার স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যালোচনা করুন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পানি, সার প্রয়োগ করুন।
সঠিক যত্নের মাধ্যমে নিম গাছটি বড় হয়ে উঠবে এবং দ্রুত ফুল, ফল বা কাঠের জন্য প্রস্তুত হবে।
আরো পড়ুনঃ গর্জন কাঠের দাম
উপসংহার – নিম গাছের চারার দাম
নিম গাছের চারা কেনা, রোপণ এবং পরিচর্যা সংক্রান্ত এই আর্টিকেলে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিম গাছ কেবল পরিবেশের জন্য উপকারী নয় এটি মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে নিম গাছের চারা কেনা সহজ এবং সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় যা সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক। পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিতে নিম গাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।